সিনিয়র রিপোর্টার : বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় অধিকাংশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। তবে তা কাঙ্খিতহারে কমছে না। কোনো কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই আদায় অযোগ্য মন্দঋণে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকের সংকট যেন কাটছেই না।
অনিয়ম, দুর্নীতি ও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি বেড়েছে চারটির, কমেছে পাঁচটির।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে ৯ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। যা গত জুন শেষে ৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা ছিল। ৩ মাসে খেলাপি কমেছে মাত্র ১৮৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক নির্দেশনার পরও শৃঙ্খলার মধ্যে আসেনি তারা। ফলে হুমকিতে পড়েছে এসব ব্যাংক। ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে আর্থিক খাত। রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণেই নিয়ম মানার কোনো তোয়াক্কা করছে না তারা। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়ার পর তারা নতুন কোনো চমক দেখাতে পারেনি। বরং শুরু থেকেই পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। নতুন কোনো পণ্য বা সেবা আনতে পারেনি। বরং পুরনো ব্যাংকের নীতি অনুসরণ করেছে। ফলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিলেও তেমন কোনো কাজে লাগাতে পারেনি।
তিনি বলেন, এসব ব্যাংককে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। তাদের নতুন নতুন পণ্য ও সেবা আনতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নতুন প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আছে পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৩১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৭০৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৩ হাজার ৯৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় নম্বরে রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪১৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায়। জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩০৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ২৪৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
মেঘনা ব্যাংকের ২৪৭ কোটি ৪ লাখ টাকা, জুন শেষে ছিল ২৪৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ২০৪ কোটি ৭৭ লাখ, যা জুনে ছিল ২০৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪৯ কোটি ৭১ লাখ, জুনে ছিল ১৫০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এনআরবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, মধুমতি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯০ কোটি ৩২ লাখ টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংকের ৭১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৫৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় গত মার্চে। তারপর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। এ সংকটকালে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেয় সরকার; সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে না। এরপর সময় বাড়িয়ে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এর আগে করোনার কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণিকরণে স্থগিতাদেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে সরকারের নির্দেশনায় পুনঃতফসিলে গণছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পান খেলাপিরা।
২০১৯ সালের ১৬ মে নীতিমালায় এ ছাড় দেয়ার পর থেকে বিশেষ বিবেচনাসহ গেল বছর পুনঃতফসিল হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের। এত সব সুবিধা নেয়ার পরও কমছে না খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুরো ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।