ডেস্ক রিপোর্ট : দেশের সিমেন্ট খাতে গত অর্থবছরের বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পরিচালনা ব্যয়, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দর বৃদ্ধি, দেশি বাজারে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে প্রায় সবগুলো কোম্পানির কমেছে মুনাফা। ফলে সমাপ্ত অর্থবছরের প্রায় সবগুলো কোম্পানির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা কমেছে। আর মুনাফা কমে যাওয়ায় আসছে নতুন বছরের শুরু থেকে পণ্যের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে কোম্পানিগুলো।
বিশ্বে বাংলাদেশ ৪০তম বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী দেশ। দেশের মোট ১২৫টি সিমেন্ট কারখানা থাকলেও ৩৩টি কোম্পানি সক্রিয় ভূমিকা পালন আছে। সবগুলো সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ৪ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চার কোটি এক লাখ মেট্রিক টন হলো কার্যকরী ক্ষমতা। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের দেশে সিমেন্টের চাহিদা ছিল তিন কোটি মেট্রিক টনের চেয়ে একটু বেশি। ফলে সিমেন্ট শিল্পে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকার পরও গত বছরের ৪০ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন হ্রাস পায়।
অপরদিকে স্থানীয় বাজারের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ও অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্লিংকারের দর কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকায় মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পায়।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেডের হিসাব মতে, দেশের তিন বৃহৎ শিল্প গ্রুপ টিকে, সী কম ও জিপিএইচের যৌথ উদ্যোগে ২০০১ সালে প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে যাত্রা করে প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড। গত অর্থবছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ছিল ৫৬ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার টাকা। যা আগের বছরে ছিল ৬৯ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে নিট মুনাফা কমেছে ১২ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
যদিও এ সময় কোম্পানিটির বার্ষিক টার্নওভার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ৯৭ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক টার্নওভার ছিল এক হাজার ৩৩ কোটি ২৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। যা আগের বছরে ছিল ৯৩৬ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পাশাপাশি একই সময় গড় আয়, কর সঞ্চিতি, এনওসিএফপিএস, গড় মুনাফা রেশিও, রিটার্ন অন অ্যাসেস্ট, রিটার্ন অন ইকুইটি এবং ইপিএস প্রভৃতি আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
এদিকে মুনাফা কমলেও আগামীর চাহিদায় লক্ষ্য রেখে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিল্পের বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় কোম্পানিগুলো বিদ্যমান উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ মেট্রিক টন। যা সম্প্রসারণের পর হবে ৪৬০ মেট্রিক টন। আর সম্প্রসারণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ভার্টিক্যাল রোলার মিলের (ভিআরএম) স্থাপন পদ্ধতি গ্রহণ করে। এর জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ৪৮৮ কোটি টাকা।
সিমেন্ট শিল্পের শক্তিশালী প্রতিযোগী ক্রাউনের পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি ও অন্যান্য ব্যয়ের কারণে মোট মুনাফা হ্রাস হয়েছে ২.৯৫%, টাকার অংকে ১,৬৫৯ মিলিয়ন থেকে ১,৬১০ মিলিয়ন টাকা, বিক্রি ৪.৬৯% বৃদ্ধি পেলেও বিক্রি ব্যয় গত বছরের তুলনায় ৬.৪২% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর কারণ হিসাবে কোম্পানির শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের মূল্য বৃদ্ধি, প্রতিযোগী উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক ব্র্যান্ডিং ব্যয়, প্রমোশনাল কর্মকাণ্ডে ব্যয় বেড়েছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের অবস্থান সুরক্ষিত করতে অনুরূপভাবে অগ্রসর হতে হয়েছে; তাই বিক্রি ও পরিবেশন ব্যয় বৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় দাঁড়িয়েছে ১৩.২৫ শতাংশ। এতদসত্ত্বেও পরিচালন মুনাফা ৭.২২ শতাংশের অধিক কমেনি। একইভাবে কনফিডেন্স সিমেন্টের আগের বছরের তুলনায় গত অর্থবছরের বিক্রি কমেছে। তবে কর-পরবর্তী মুনাফা কিছুটা বেড়েছে।
সিমেন্ট কোম্পানির একাধিক উদ্যোক্তার মতে, বাংলাদেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ১২৫ কেজি। ভারতে মাথাপিছু ব্যবহার ২২৫ কেজি আর পাকিস্তানে ১২৯ কেজি। মাথাপিছু সিমেন্ট ব্যবহারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব। দেশটিতে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় এক হাজার ৭০০ কেজি। আর সারা বিশ্বে মাথাপিছু গড় ব্যবহার ৫০০ কেজি। ফলে বাংলাদেশে এ খাতের প্রবৃদ্ধির অনেক সুযোগ আছে।
২০০০ সালের আগে সিমেন্টের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। কিন্তু ২০০০ সালের পর দেশি অনেক কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগ করায় সিমেন্টের বাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একক আধিপত্য কমতে শুরু করে। আর আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ বাজারের সিংহভাগই দেশি কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
প্রিমিয়াম সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক বলেন, আমাদের কোম্পানির ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১.৮১ মিলিয়ন টন। এর আগের বছরে ছিল ১.৫৫ মিলিয়ন টন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে আমাদের উৎপাদন ও অপারেশনাল ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া কঠিন প্রতিযোগিতার কারণে দর বাড়ানো সম্ভব হয়নি। যার ফলে কর পরিশোধের পর কোম্পানির নিট মুনাফা হ্রাস পেয়ে ৫৬২.০০ মিলিয়ন টাকায় দাঁড়ায়। যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬৯১.১১ মিলিয়ন টাকা।’
উল্লেখ্য, দেশের সিমেন্ট বাজারের ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণে আছে আবুল খায়ের গ্রুপের শাহ্ সিমেন্ট, বসুন্ধরা গ্রুপের মেঘনা ও বসুন্ধরা সিমেন্ট, সেভেন রিংস ব্র্যান্ডের সিমেন্ট, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, ক্রাউন ব্র্যান্ডের এমআই সিমেন্ট, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, হোলসিম সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, মদিনা সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট।
বাকি ২০ শতাংশ দখলে রেখেছে যে ২১ কোম্পানি, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডায়মন্ড সিমেন্ট, অ্যাংকর ব্র্যান্ডের অলিম্পিক সিমেন্ট, দুবাই-বাংলা সিমেন্ট, ইমিরেটস সিমেন্ট, সিয়াম সিটি সিমেন্ট ও সেনাকল্যাণ সংস্থার মোংলা সিমেন্ট কোম্পানি।